প্রকাশিত: Sat, Jun 8, 2024 2:51 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 10:57 PM

সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেবল সাধারণ একটা অপরাধের তদন্তের মধ্যে সীমিত রাখলে হবে না

ইমতিয়াজ মাহমুদ

[১] সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ভারতের নির্বাচন নিয়ে আমাদের নিজেদেরও একটু আলোচনা করা দরকার। আলোচনা করা দরকার, কেননা ওদেরটাই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। আর ওদের সরকারের ধরনটাও হচ্ছে অনেকটা আমাদের মতোই পার্লামেন্টারি ধরনের-ওদেরটা অবশ্য ফেডারেল পদ্ধতির। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ওদের সাথে আমাদের বেশ মিলও আছে কিছু কিছু। এছাড়া আমাদের তিন দিক ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত- আপনি ভারতকে ভালোবাসতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, কিন্তু ভারতকে এড়িয়ে তো থাকতে পারবেন না। সুতরাং দেশের সকল পর্যায়েই ভারতের নির্বাচনটা আলোচনা হওয়া দরকার। আমার নিজের তো নানা কথা লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন কিনা একটু কাজের চাপও আছে, আর কিঞ্চিৎ আলস্য সে তো আমার অনেক পুরনো ব্যাধি-পেটের মধ্যে নানা কথা ভুটভাট করে বটে, কিন্তু সেগুলি আর লেখা হচ্ছে না। আরেকটা প্রসঙ্গ আছে যেটা নিয়ে একটু বিস্তৃত লেখা দরকার। 

এই যে আমাদের পুলিশ প্রধান ও সাবেক জঅই প্রধানের সম্পদ বের হচ্ছে নানা জায়গায়, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেই প্রসঙ্গটা। কেননা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে যারা দুর্নীতি করে সকল দুর্নীতিই অপরাধ বটে, কিন্তু কিছু কিছু পদে থাকা ব্যক্তির দুর্নীতির অপরাধের মাত্রা ও ব্যপ্তি অন্যদের তুলনায় একটু বেশি হয়। উদাহরণ দিই। আমি আর মুস্তাফিজ এটা আলোচনাও করছিলাম সেদিন। ধরেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী যদি কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে ঘুষ নেয় সেটা তো অবশ্যই দুর্নীতি এবং সকল দুর্নীতিই অপরাধ, সকল দুর্নীতিই কোনো না কোনোভাবে আমাদের সকলের ক্ষতি করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের দুর্নীতির ফলাফল আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। কিন্তু পুলিশের প্রধান যদি দায়িত্বরত অবস্থায় দুর্নীতি করে সেটার প্রভাব ও ব্যপ্তি বড় ভয়ংকর হতে পারে। কেননা পুলিশের হাতে যে দায়িত্ব, আইনশৃঙ্খলা, এটা আমাদের লিবার্টি ও জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করে এবং রাষ্ট্রের একটা মৌলিক দায়িত্বে অভিঘাত করে। 

[২] পুলিশের দুর্নীতির একটা সরাসরি ফল হয় অপরাধীদের বিচারের হাত গলে বের হয়ে যাওয়া এবং নিরপরাধ ব্যক্তির শাস্তি বা ভোগান্তি হওয়া। অন্য ভাষায় বললে, রাষ্ট্রের যে অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব-আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিচার নিশ্চিত করা, এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার স্বাধীনভাবে কাজ নিশ্চিত করা-এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভেস্তে যেতে পারে পুলিশের প্রধান বা সাধারণভাবে পুলিশ বাহিনী যদি দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। পুলিশের প্রধানের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তো আমাদের আঁতকে উঠতে হয়। এই লোক এতো সম্পদ করার টাকা পেলো কী করে? তবে কি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বা অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে গণদুর্নীতি হয়েছে? এজন্যে পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সেটার তদন্ত একটু বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। জ্ঞাত আয়ের চেয়ে সম্পদ বেশি হলেই অপরাধ হয়ে যায়, শুধু সেটার জন্যও জেল হতে পারে। কিন্তু এই লোকের দুর্নীতির কারণে যদি কোনো নাগরিক অন্যায়ভাবে জেলে গিয়ে থাকে, যদি কোনো অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়, সেগুলির কী হবে? আর পুলিশ, র‌্যাব বা অন্য কোনো বাহিনীর প্রধান যদি দুর্নীতি করে তাইলে সেটা তো তিনি একা করতে পারবেন না, অনিবার্যভাবেই তাঁর বাহিনীর অন্য কিছু কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট থাকবে এবং নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন যে ফৌজদারি তদন্ত ও বিচারে এইসবের ফলে কোনো না কোনোভাবে অন্যায় হয়েছে। 

এজন্য বিচারটা বিস্তৃত করা দরকার। কেবল জ্ঞাত আয়ের বহির্ভূত সম্পদের মধ্যে সীমিত থাকলে, বা কেবল অভিযুক্ত ব্যক্তির দুর্নীতি প্রমাণের মধ্যে সীমিত থাকলে হবে না। যেসব ব্যক্তির প্রতি অন্যায় হয়েছে, রাষ্ট্রের সংবিধানে প্রদত্ত আইনের আশ্রয় থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছে ওদের জন্যে ন্যায় নিশ্চিত করতে হবে না? সেটা করতে হলে তো দুর্নীতির তদন্তের পাশাপাশি পুলিশে থাকা অবস্থায় এই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে কতজন নাগরিক বিচার বঞ্চিত হয়েছে। এটা যদি না করতে পারি আমরা তাইলে তো বটে হয় যে রাষ্ট্র হিসাবে আমরা ব্যর্থ। কেননা এইটা তো রাষ্ট্রের একটা মৌলিক দায়িত্ব। [৩] আরেকটা কথা, দেশের পুলিশ বাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিজ্ঞ ওঠে, আর সেইসব দুর্নীতির নমুনা হিসাবে যখন দেশের নানা জায়গায় জায়গাজমি বেড় হতে থাকে যেগুলি ওই লোক চাকরিতে থাকা অবস্থায় কিনেছে, তখন অভিযোগটা আর একজন সরকারি কর্মকর্তার বুক্তিগত অপরাধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা আমার রাষ্ট্রের এবং সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগায়। সাংবিধানিকভাবে এরকম পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এবং সার্বিকভাবে পুরো সরকারকেই জবাবদিহি করতে হয়। দেশে একটা কার্যকর গণতন্ত্র থাকলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জবাবদিহি করতেন এবং দায় নিয়ে পদত্যাগ করতেন। সংক্ষেপে বলি। সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কেবল সাধারণ একটা অপরাধের তদন্তের মধ্যে সীমিত রাখলে হবে না,বিস্তারিত তদন্ত করে দুর্নীতির প্রতিটি টাকার উৎস, প্রতিটি দুর্নীতি, প্রতিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চিহ্নিত করতে হবে। সরকারকে, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের সকল কর্মকাণ্ডের কৃতিত্ব ও দায় দুইটাই সরকারের। একজন আইজি যদি দুর্নীতি করে, সেটার জন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও দায় আছে। সরাসরি জড়িত না থাকলে মন্ত্রীর জেল হবে না, এটা রাজনৈতিক দায়, সাংবিধানিক দায়, মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে অবশ্য আলাদা কথা, তখন জনগণের প্রতি বা সংবিধানের প্রতি কারো কোনো দায় দায়িত্ব থাকে না। তখন এক ব্যক্তির প্রতি নিশ্চিত আনুগত্য থাকলেই হয়ে যায়। লেখক: আইনজীবী। ফেসবুক থেকে